অফিস থেকে দিন দুই ছুটি নিয়ে ধানবাদ এসেছি মেজপিসির বাড়িতে।
জানুয়ারি মাসের শীত শীত বিকেল। পিসেমশাই ছাতে পাতা মোড়ায় বসে প্রাণপণে গুল দিয়ে চলেছেন।
আমি ছাতের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নেড়ে চলেছি আর উস্কানিমূলক স্টাইলে "যা বলেছো পিসে" বা "আইব্বাস, বলো কী" ধরণের ইতিউতি মন্তব্য ভাসিয়ে দিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি।
পিসেমশাই একের পর এক গাছে-গরু-উঠে-আলু-ভাতে-মাখছে গোছের গপ্প দিয়ে প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে ভাগ্যের দোষে আজ তাঁর চীফ মিনিস্টার হওয়াটা আটকে গেলো (ভাগ্যের দোষটা অবশ্যই এ পোড়া দেশের, পিসেমশাইয়ের নয়)। তিরিশ বছর ধরে কোলিয়ারি অফিসে জার্নাল এন্ট্রি করে যাওয়াটা কাছে একটা "হাইলি মেডিটেটিভ" অভিজ্ঞতা। ধানবাদের কত মাফিয়া, গুণ্ডা, মাস্তানকে যে স্রেফ নিজের ব্যক্তিত্বের ধার দিয়ে ফালাফালা করেছেন, সে গল্পও হচ্ছিল। কী একটা প্রসঙ্গে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথাও এলো। শাস্ত্রীবাবু নাকি একবার কয়লাখনি ভিজিট করতে এসে পিসের সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, "দাসবাবু, আপ য্যায়সা জ্ঞিয়ানি ব্যক্তি কো তো কিসি কালিজ কা প্রাফেসর ইয়া পার্লামেন্ট কা স্পীকার হোনা চাহিয়ে থা"। পিসেমশাই নাকি স্মিত হেসে শাস্ত্রীজীকে মাসলোর পিরামিড এঁকে বুঝিয়েছিলেন যে সেলফ-অ্যাকচুয়ালাইজ করতে তাঁর কলেজের বেয়াদপ ছাত্র বা পার্লামেন্টের হুলিগ্যানদের সার্টিফিকেটের দরকার নেই। "গা ছুঁয়ে বল এই কথাটা তুই সিক্রেট রাখবি"; এই প্রতিশ্রুতির বাঁধনে বেঁধে পিসেমশাই স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে লালুবাবু সে'দিন তাঁর পার্সোনাল ডায়েরিতে পিসেমশাইয়ের অটোগ্রাফ নিয়ে দিল্লী ফিরে গেছিলেন। আমি শুনে সাংঘাতিক ইম্প্রেসড হলাম। পিসেমশাইয়ের গল্প বলার স্টাইলে একটা মারাত্মক জোর আছে, সোজাসাপটা গুলগুলোও নাটুকে ডেলিভারির জন্য অপূর্বভাবে উতরে যায়।
আলো কমে এলে হাওয়ায় কনকন বাড়ে। পিসেমশাইকে বলি, "চলো পিসে, এই বয়সে বুকে ঠাণ্ডা বসলে একটা কেলেঙ্কারি হবে"।
পিসে হেসে বলেন, "তোকে বলেছি আমার নেপালের জঙ্গলের এক্সপিরিয়েন্সটা? বলিনি বোধ হয়। জানলে আর আমায় ধানবাদের ছাতের হাওয়ার থ্রেট দিতিস না"।
"পিসে, নীচেই চলো। আলুর চপ নিয়ে এসে জমিয়ে বসা যাবে"।
"ইউ আর আ গুড লিসেনার পিলু"।
"বলছো"?
"সেই কোয়ালিটি অবশ্য তোর পিসির থেকেই ইনহেরিট করা"।
"তোমার মত বর থাকলে ভালো গপ্প-শুনিয়ে না হয়ে কোনও উপায় আছে কি পিসে"?
"গপ্পে তোর পিসিকে এতই পিষলাম যে জাস্ট সরে পড়লো"।
"পিসে, ডোন্ট মাইন্ড। পিসির কথা এসে পড়লেই তোমার গল্পের ধার কমে যায়"।
"স্বাভাবিক। তোর পিসি তোর মতই বোরিং ছিল কিনা। ধর বললাম চলো ছ'মাসের ছুটি নিয়ে অ্যাফ্রিকা ঘুরে আসি। বলে কিনা তার চেয়ে বরং চারদিন ছুটি নিয়ে চলো বোলপুর ঘুরে আসি। আমার ইচ্ছে মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে ব্যাক্ট্রিয়ান ক্যামেলের রোস্ট খাবো, তোর পিসি প্ল্যান করছে পাবদার ঝোলের। কী মারাত্মক ম্যাড়ম্যাড়ে বল দেখি"!
"একদমই"!
"কী জানিস পিলু, সে বোরিং জীবন আর একমিনিটের জন্যও যদি ফেরত পেতাম রে, কয়েক সেকেন্ডের জন্যও যদি যে ফিরে আসতো...। কে জানে ভাই, বোলপুরে বসে পাবদার ঝোল খেয়ে হয়তো অমৃতলাভ হতো"।
"ধানবাদের আলুর চপে সে অমৃত নেই বলছো"?
"আলুর চপ! পিলু, তুই পিসির ভাইপো না ছেলে কে জানে। যাক গে, একটু ধরে নামা দেখি। ছাতের হাওয়াটা বড্ড ঠাণ্ডা; গলার কাছটা কেমন খুসখুস করছে। রায়দা তো নেই যে টুক করে দু'দাগ খাইয়ে দেবে আর দশ মিনিটে কাশি সাফ"।
"এসো, নামা যাক। ইয়ে, রায়দাটা কে"?
"বিধান। বিধান রায়। অফ কৌর্স"!
No comments:
Post a Comment